হায়া সোফিয়ায় নামাজ আদায়ের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

গত ১৭ জুলাই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘হায়া সোফিয়াকে আবারো মসজিদে রূপান্তরিত করা হলো তুরস্কের সার্বভৌমত্বের ব্যাপার। তুরস্ক মনে করে না যে, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মতামত কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।’ 

একই দিনে তুর্কি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন সিএনএনকে বলেন, ‘হায়া সোফিয়াতে যে কেউ ঢুকতে পারবেন এবং এর অভ্যন্তরের ঐতিহাসিক মোজাইক গত ৫০০ বছরের মতোই রক্ষা করা হবে। তুরস্ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে করে এই মোজাইক নামাজের সময় ঢেকে রাখা যায়। হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া পুরনো ধারণা থেকে এসেছে। বর্তমানে তুরস্কে ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘তুরস্কে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সমঅধিকার পাচ্ছে; যা কিনা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারা সম্ভব। তুরস্ক ইতিমধ্যেই ক্যাথোলিক চার্চের পোপসহ অনেককেই হায়া সোফিয়াতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।’ 

গত ১০ জুলাই হায়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের পক্ষে তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালতের রায় পাওয়ার পর থেকে প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো এই স্থাপনা নিয়ে চলছে ব্যাপক বাকযুদ্ধ। হায়া সোফিয়ার ইতিহাস ও এর সাথে বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে বুঝতে হবে এর গুরুত্ব আসলে কতখানি।

৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপোল শহরে হায়া সোফিয়া নির্মিত হয় ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের উপাসনালয় হিসেবে। একাদশ শতকে ইস্টার্ন অর্থোডক্স থেকে ক্যাথোলিক চার্চ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা বাইজ্যান্টাইন রাজ্যের প্রায় পুরোটাই দখল করে নেয় এবং কন্সটানটিনোপোল শহর লুট করে। ক্যাথলিক ক্রুসেডারদের তৈরি করা লাতিন সাম্রাজ্যের অধীনে ১২৬১ সাল পর্যন্ত এটা ক্যাথোলিক চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লাতিন সাম্রাজ্যকে বাইজ্যান্টাইনরা ফ্রাঙ্কদের (বর্তমানে ফ্রান্স) সাম্রাজ্য বলত। ক্যাথলিকরা ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চকে পুরোপুরি নির্মূল করে দেয়ার চেষ্টা করলেও ১২৬১ সালে কন্সটানটিনোপোল শহর আবারো বাইজ্যান্টাইনদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সে সময় থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত হায়া সোফিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

১৪৫৩ সালে উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ কন্সটানটিনোপোল জয় করেন। মেহমেদ ‘আল ফাতিহ’ হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন এবং সেখানে নামাজ আদায়ের প্রচলন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফত ধ্বংসের পর মুস্তফা কেমাল আতাতুর্কের অধীনে সেক্যুলার তুরস্ক তৈরি হলে ১৯৩১ সালের পর থেকে হায়া সোফিয়াতে প্রথমবারের মতো সব ধরনের উপাসনা বাতিল করা হয়। 

১৯৩৪ সালে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। তুর্কি সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৯ সালে ৩৭ লাখ পর্যটক হায়া সোফিয়া দেখতে এসেছিলেন।

অনেকেই বলছেন, হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের মাধ্যমে এরদোয়ান নিজ দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাকে ঢাকতে চাইছেন। নিকেই এশিয়ান রিভিউ এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৯ সালের মার্চের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন একে পার্টি আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর এরদোয়ান এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে জোর দিয়েছেন। 

আরব নিউজের এক লেখায় ধর্মবিষয়ক কনসালট্যান্ট পিটার ওয়েলবি বলেন, ‘বর্তমান তুরস্কে বহু ধরনের সমস্যা থাকলেও মসজিদের অভাব সেই সমস্যাগুলোর একটি নয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে তুরস্ক মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করতে চাইছে।’ 

জুনের প্রথম সপ্তাহে করা এক জনমত জরিপের বরাত দিয়ে তুর্কি পত্রিকা ইয়েনি সাফাক জানায়, তুরস্কের ৭৩ শতাংশ জনগণ হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের পক্ষে, ২২ শতাংশ বিপক্ষে, চার শতাংশ কোনো মতামত দেয়নি।

হায়া সোফিয়ার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব খুব শক্ত কোনো শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের ঘোষণায় ‘হতাশা’ ব্যক্ত করে। ক্যাথলিক চার্চের পোপ ফ্রান্সিস এতে ‘খুবই ব্যথিত’ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেফ বোরেল জানান, ইইউর মাঝে হায়া সোফিয়াকে আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে এবং তারা তুরস্ককে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানাবেন। 

তবে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারীরা তাদের আবেগ প্রকাশ করেছেন। রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল বলেছেন, তিনি ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ এবং মনে করছেন, এটি ‘পুরো খ্রিস্টান সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ’। 

গ্রিক সংস্কৃতিমন্ত্রী লিনা মেনডোনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত তুরস্ককে ছয় শতক পেছনে নিয়ে গেছে এবং এটি ‘সভ্য দুনিয়ার প্রতি সরাসরি হুমকি’। রাশিয়ার পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির উপ-প্রধান ভ্লাদিমির জাভারভ বলেছেন, ‘এতে মুসলিম দুনিয়ার কোনো উপকার হবে না; বরং বিভিন্ন জাতিকে একে-অপরের বিপক্ষে দাঁড় করাবে।’ 

হায়া সোফিয়ার ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব থেকে আসা বিভিন্ন সমর্থনের এক তালিকা তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে প্রকাশ করে নিকেই এশিয়ান রিভিউ; যেখানে ওমান, ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নাম রয়েছে; তবে আরব দেশগুলোর নাম নেই। আরব আমিরাতের সংস্কৃতিমন্ত্রী নৌরা আল-কাবি এক টুইটার বার্তায় তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। 

ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, হায়া সোফিয়ার এই সিদ্ধান্তে তুরস্ক মুসলিম আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশে ও বিশ্বব্যাপী বেশকিছু সমর্থন জুগিয়েছে। তবে আরব বিশ্বের সমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট ভিতের পশ্চিমা সেক্যুলার দুনিয়া ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের আলাদা করে কঠোর বার্তা দেয়নি, যা চার্চের কয়েক শতকের দ্বন্দ্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়। 

পশ্চিমাদের সাথে রুশদের চলমান টানাপড়েনের মাঝে এই ঘটনা জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে, এরদোয়ানও তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু ফসল ঘরে তুলে নেবেন। 

বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নতুন কোনো বিভেদের জন্ম না দিলেও, এটি তুর্কি জনগণের একাংশকে মুসলিম আবেগে তাড়িত করবে এবং বিশ্বব্যাপী তুরস্কের গুরুত্ব বাড়িয়েছে- ব্যাপারটা কারও পছন্দ হোক বা না হোক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //